৩৫ কোটি টাকার ফুলের বাজার ধরতে ব্যস্ত যশোরের গদখালী ও শার্শার ফুল চাষীরা
তুহিন হোসেন, বেনাপোল প্রতিনিধিঃ
দরজায় কড়া নাড়ছে বসন্ত ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আর এ তিন দিবসে ফুলের বাজার ধরতে ব্যস্ত সময় পার করছেন ফুলের রাজ্য খ্যাত যশোরের গদখালি ও শার্শা এলাকার ফুলচাষীরা। ফুল ব্যবসায়ীদের কাছে পুরো ফ্রেরুয়ারী মাসটি উৎসবের মাস হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। দু’বছর আগের বসন্ত বরণ ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে প্রিয়জনের মন রাঙাতে গদখালীর ফুলচাষিরা নতুন উপহার হিসেবে এনেছিলেন ‘লং স্টিক রোজ’। ভারতের পুনে থেকে চারা এনে ৪০ শতক জমিতে দেশে প্রথমবারের মতো বিশেষ ধরনের গোলাপের জাতটির চাষ শুরু করেছিলেন যশোরের গদখালীর ইনামুল হোসেন। অন্য জাতের গোলাপ ফুল গাছ থেকে তোলার পর যেখানে ৪-৫ দিনের বেশি রাখা যায় না, সেখানে লং স্টিক গোলাপ রাখা যায় দুই সপ্তাহ পর্যন্ত। এর স্টিক বেশ শক্ত। দামও মিলছে দ্বিগুণ। এসব কারণে ইনামুলের দেখাদেখি এ অঞ্চলের বেশিরভাগ চাষির মাঠে শোভা পাচ্ছে গোলাপের নতুন এই জাত। তবে এবার নতুন জাতের ফুল উপহার দিতে না পারলেও এখানকার চাষিরা ফুল প্রেমীদের দিচ্ছেন চমকপ্রদ খবর। টিস্যু কালচারের মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত জারবেরা চারায় ফুল ফোটাতে যাচ্ছেন তারা। এ গাছে আগামী বাংলা নববর্ষের আগেই ফুল ফুটবে বলে আশা করছেন চাষিরা। এতদিন বেঙ্গালুর থেকে চারা এনে জারবেরা চাষ করতেন চাষীরা। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আরআরএফ যশোরের টিস্যু কালচার সেন্টার জারবেরার চারা তৈরি করছে। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির তথ্যমতে, এবার যশোরে পাইকারি পর্যায়ে প্রায় ৩৫ কোটি টাকার ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যশোরে প্রায় ৬ হাজার ফুল চাষী ৬৪০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন প্রকার ফুল চাষের সাথে সম্পৃক্ত।এখানে বেশি চাষ হয় গ্যালোরিয়াস ,রজনীগন্ধা ও গোলাপ। তাদের উৎপাদিত জারবেরা, গাঁদা, জিপসি, রডস্টিক, কেলেনডোলা, চন্দ্র মল্লিকাসহ ১১ ধরনের ফুল সারাদেশের মানুষের মন রাঙাচ্ছে । সরেজমিনে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালি, পানিসারা, নাভারণ, শার্শার উলাশী এলাকার মাঠ ঘুরে দেখা গেছে, ‘লং স্টিক রোজে’র পাশাপাশি বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে এখন দোল খাচ্ছে জারবেরা, গোলাপ, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, হলুদ গাঁদা ও চন্দ্রমল্লিকাসহ হরেক রকমের ফুল। বাতাসে ফুটন্ত ফুলের সুবাস ছড়িয়ে যাচ্ছে চারদিকে। ফলন ও দাম ভালো হওয়ায় ফুলের হাসি লেগেছে চাষিদের চোখেমুখেও। শার্শার উলাশীর ফুল চাষী দিলদার হোসেন জানান,ফুলচাষে আসা বংশ পরমপরায়। আমার বাবা ফুল চাষ করতো। এখন আমিও ফুল চাষের সাথে সম্পৃক্ত। আমি তিন বিঘা জমিতে ফুল চাষ করেছি। তার মধ্যে এক বিঘা রজনীগন্ধা একবিঘা গোলাপ ও এক বিঘা জারবেরা । সামনে ফুলের বড় বাজার তাইতো বাজার ধরতে সকাল-বিকাল ফুলের পরিচর্যা করছি। প্রতিটি গোলাপে ক্যাপ পরানোসহ খরচ প্রায় ৪ টাকার মতো। যদি ৭-৮ টাকা বিক্রি করা যায় তাহলে মুনাফা বেশি পাওয়া যাবে। ফুল চাষের উপর প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি সফলভাবে ফুল চাষ করে যাচ্ছেন। গদখালীর ফুল চাষি ও ব্যবসায়ী ইসমাঈল হোসেন জানান, পৈতৃক জমিতে তিনি আগে ধান-পাট ও রবিশস্যের আবাদ করতেন। এখন সেখানে ফুল চাষ করেন। এতে তিনি আর্থিকভাবে অধিক লাভবান হয়েছেন। বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, যশোরের ঝিকরগাছা, শার্শা উপজেলাসহ এ জেলায় বাণিজ্যিকভাবে ফুলের চাষ হচ্ছে। ১৯৮৩ সালে গদখালীতে মাত্র ৩০ শতক জমিতে ফলদ ও বনজ গাছের নার্সারির মালিক শের আলী গোড়াপত্তন ঘটিয়েছিলেন ফুল চাষের।বর্তমানে ইউরোপের বাজারে ফুল রপ্তানির আশায় পলি হাউসে ফুলের আবাদ করছেন এখন চাষিরা। তারা বলছেন, পলি হাউসে তাপমাত্রা সঠিক মাত্রায় থাকার কারণে বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী গোলাপ ফুল উৎপাদন হবে। দেশে ফুলের মোট চাহিদার ৭০ ভাগই যশোরের গদখালী ও শার্শা থেকে সরবরাহ করা হয়। বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে ৩০ লক্ষ মানুষের জীবিকা এই চাষ বা ফুলকে কেন্দ্র করে। প্রায় ২০ হাজার কৃষক ফুলচাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এর মধ্যে কেবল যশোরেই প্রায় ৭ হাজার ফুলচাষী রয়েছেন। যশোর আঞ্চলিক কৃষি অফিসের উপ-পরিচালক এমদাদ হোসেন জানান, এবার জেলায় ৬৪০ হেক্টর জমিতে ফুলের আবাদ করা হয়েছে। দেশের মোট চাহিদার প্রায় ৬০ ভাগের বেশি যশোরের গদখালী ও শার্শা থেকে সরবরাহ করা হয়। দেশের গন্ডি পেরিয়ে ফুল এখন যাচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়ায়।